ঢেঁড়স খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা-সম্পর্কে যেনে নিন
ঢেঁড়স, যাকে আমরা অনেকেই ভেন্ডি বা লেডিস ফিঙ্গার নামে চিনি, এটি একটি পুষ্টিকর
সবজি যা স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। ঢেঁড়সের ভিটামিন, খনিজ এবং আঁশ সমৃদ্ধ
গুণাবলি একে সুপারফুড হিসেবে জনপ্রিয় করে তুলেছে।
তবে, এর উপকারিতার পাশাপাশি কিছু সম্ভাব্য অপকারিতাও আছে, যা জেনে রাখা ভালো। এই
আর্টিকেলে আমরা ঢেঁড়স খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
পেজসূচিপত্র:ঢেঁড়স খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত
ঢেঁড়স খাওয়ার উপকারিতা
১. প্রচুর আঁশ সরবরাহ
ঢেঁড়সের মধ্যে প্রচুর আঁশ থাকে যা আমাদের হজমপ্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। এটি
কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করে এবং পাকস্থলীর কার্যকারিতা বাড়ায়। আঁশ সমৃদ্ধ খাবার রক্তে
শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য
বিশেষভাবে উপকারী।
২. হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
ঢেঁড়সের মধ্যে থাকা আঁশ ও অন্যান্য উপাদান রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে
সাহায্য করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে। এছাড়াও, ঢেঁড়সের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
উপাদান রক্তনালীগুলোর কার্যকারিতা উন্নত করে, যা হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সাহায্য
করে।
৩. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
ঢেঁড়সের মধ্যে থাকা ফাইবার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে কার্যকর। এটি
ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি একটি
আদর্শ সবজি হিসেবে বিবেচিত।
৪. অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ
ঢেঁড়সে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি এবং অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা
শরীরের কোষগুলোকে ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিক্যাল থেকে রক্ষা করে। এটি ক্যান্সারের
ঝুঁকি কমাতে এবং বার্ধক্য প্রতিরোধে সহায়তা করে।
৫. হাড় মজবুত করে
ঢেঁড়সে থাকা ভিটামিন কে এবং ক্যালসিয়াম হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই
গুরুত্বপূর্ণ। এটি হাড়ের ঘনত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকি
কমায়।
৬. ত্বকের যত্নে সহায়ক
ঢেঁড়সের ভিটামিন সি এবং অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে
সহায়তা করে। এটি ত্বকের লাবণ্য ধরে রাখে এবং বলিরেখা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
৭. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
ঢেঁড়সে থাকা ভিটামিন সি এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। নিয়মিত ঢেঁড়স খাওয়ার ফলে শরীর ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার
সংক্রমণ থেকে রক্ষা পায়।
৮. গর্ভাবস্থায় সহায়ক
গর্ভবতী নারীদের জন্য ঢেঁড়স খুবই উপকারী। এতে থাকা ফলেট শিশুদের সঠিক মস্তিষ্ক ও
স্পাইনাল কর্ডের বিকাশে সহায়তা করে। গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে ফলেট প্রয়োজন হয় বলে
এটি গর্ভবতী মহিলাদের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
ঢেঁড়সে যে সকল পুষ্টি উপাদান রয়েছে
ঢেঁড়স (ভেন্ডি) পুষ্টিতে ভরপুর একটি সবজি, যা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের সমৃদ্ধ
উৎস। ঢেঁড়সে ভিটামিন, খনিজ, এবং অন্যান্য পুষ্টিকর উপাদান রয়েছে, যা স্বাস্থ্যের
জন্য অত্যন্ত উপকারী। নিচে ঢেঁড়সের প্রধান পুষ্টি উপাদানগুলো বিস্তারিতভাবে
আলোচনা করা হলো:
১. কার্বোহাইড্রেট
ঢেঁড়সে প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট থাকে, যা আমাদের দেহের শক্তির মূল উৎস।
ঢেঁড়সে সহজেই হজমযোগ্য কার্বোহাইড্রেট থাকে, যা দ্রুত শক্তি সরবরাহ করে।
২. আঁশ
ঢেঁড়সের মধ্যে উচ্চ মাত্রায় আঁশ বা ফাইবার রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম ঢেঁড়সে প্রায়
৩.২ গ্রাম আঁশ থাকে। এই আঁশ হজমপ্রক্রিয়া সঠিকভাবে চালাতে সাহায্য করে, পেট
পরিষ্কার রাখে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে। আঁশ রক্তের কোলেস্টেরল কমায় এবং
রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক।
৩. ভিটামিন সি
প্রতি ১০০ গ্রাম ঢেঁড়সে প্রায় ২৩ মি.গ্রাম ভিটামিন সি থাকে। ভিটামিন সি একটি
শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এটি ত্বকের
স্বাস্থ্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেমন ত্বকের বলিরেখা কমানো এবং
ত্বক উজ্জ্বল রাখা।
৪. ফলেট
ঢেঁড়সে ফলেট বা ভিটামিন বি৯ এর উপস্থিতি রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম ঢেঁড়সে প্রায় ৬০
মাইক্রোগ্রাম ফলেট থাকে। গর্ভবতী নারীদের জন্য ফলেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি
শিশুর মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে সাহায্য করে। এছাড়াও, ফলেট রক্ত
তৈরিতেও সহায়তা করে।
৫. ভিটামিন কে
ঢেঁড়সে ভিটামিন কে থাকে, যা রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে এবং হাড়ের
স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতি ১০০ গ্রাম ঢেঁড়সে প্রায়
৩১.৩ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে থাকে।
৬. ভিটামিন এ
প্রতি ১০০ গ্রাম ঢেঁড়সে প্রায় ৩৬ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন এ থাকে, যা চোখের
স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়ক। ভিটামিন এ ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষা করতেও সাহায্য করে
এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে।
৭. ভিটামিন বি৬
ঢেঁড়সে ভিটামিন বি৬ (পাইরিডক্সিন) থাকে, যা আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের সঠিক
কার্যকারিতা বজায় রাখতে এবং হরমোন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
৮. পটাসিয়াম
প্রতি ১০০ গ্রাম ঢেঁড়সে প্রায় ২৯৯ মি.গ্রাম পটাসিয়াম থাকে। পটাসিয়াম রক্তচাপ
নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে এবং হৃদপিণ্ডের সঠিক কার্যকারিতা বজায় রাখে। এটি
শরীরের ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্য রক্ষায়ও সহায়তা করে।
৯. ক্যালসিয়াম
প্রতি ১০০ গ্রাম ঢেঁড়সে প্রায় ৮১ মি.গ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে, যা হাড় ও দাঁতের গঠনে
সহায়তা করে এবং হাড়ের ঘনত্ব বাড়ায়। ক্যালসিয়াম হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য।
১০. ম্যাগনেসিয়াম
ঢেঁড়সে প্রচুর ম্যাগনেসিয়াম থাকে, যা আমাদের পেশী এবং স্নায়ুসমূহের কার্যকারিতা
বজায় রাখতে সহায়ক। প্রতি ১০০ গ্রাম ঢেঁড়সে প্রায় ৫৭ মি.গ্রাম ম্যাগনেসিয়াম থাকে।
১১. ফসফরাস
ফসফরাস ঢেঁড়সের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান, যা হাড়ের গঠন মজবুত করে এবং
দেহের কোষীয় কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে সাহায্য করে। প্রতি ১০০ গ্রাম
ঢেঁড়সে প্রায় ৬৩ মি.গ্রাম ফসফরাস থাকে।
১২. আয়রন
প্রতি ১০০ গ্রাম ঢেঁড়সে প্রায় ০.৮ মিলিগ্রাম আয়রন থাকে। আয়রন রক্তে হিমোগ্লোবিন
তৈরিতে সহায়তা করে, যা শরীরে অক্সিজেন পরিবহনের জন্য অপরিহার্য। আয়রনের অভাবে
অ্যানিমিয়া হতে পারে, তাই নিয়মিত ঢেঁড়স খাওয়া শরীরে আয়রনের ঘাটতি পূরণে সহায়তা
করে।
১৩. জিঙ্ক
ঢেঁড়সে জিঙ্ক রয়েছে, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং সেলুলার
মেটাবলিজমের জন্য প্রয়োজনীয়। এছাড়াও, জিঙ্ক ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষা এবং ক্ষত
দ্রুত নিরাময়ে সহায়তা করে।
১৪. অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
ঢেঁড়সের ভিটামিন সি এবং ভিটামিন এ সহ বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের ফ্রি
র্যাডিক্যালের ক্ষতি থেকে কোষগুলোকে রক্ষা করে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় এবং
বার্ধক্যের প্রক্রিয়াকে ধীর করে।
১৫. লো ক্যালোরি
ঢেঁড়স একটি লো-ক্যালোরি সবজি, যার ফলে এটি ওজন কমানোর ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত করা
যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম ঢেঁড়সে মাত্র ৩৩ ক্যালোরি থাকে, যা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে
সহায়তা করে।
১৬. ফাইটোকেমিক্যালস
ঢেঁড়সে বিভিন্ন ধরনের ফাইটোকেমিক্যালস, যেমন পলিফেনল, ফ্ল্যাভোনয়েডস, এবং
অ্যান্থোসায়ানিন থাকে, যা শরীরকে প্রদাহ কমাতে এবং দীর্ঘমেয়াদী রোগ প্রতিরোধে
সাহায্য করে।
ঢেঁড়স খাওয়ার অপকারিতা
আরো পড়ুনঃনিয়মিত কলা খাওয়ার উপকারিতা
১. অতিরিক্ত খাওয়া ডায়ারিয়া সৃষ্টি করতে পারে
যদিও ঢেঁড়স হজমে সহায়তা করে, তবে অতিরিক্ত ঢেঁড়স খেলে এটি ডায়ারিয়া বা হজমের
সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ঢেঁড়সে প্রচুর আঁশ থাকে, যা অতিরিক্ত গ্রহণ করলে পেটের
গ্যাস, ফোলাভাব এবং ডায়ারিয়া হতে পারে।
২. কিডনির পাথরের ঝুঁকি
ঢেঁড়সে অক্সালেট নামক একটি উপাদান থাকে, যা কিডনির পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। বিশেষ
করে যারা কিডনি পাথরের সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য ঢেঁড়সের অতিরিক্ত সেবন ক্ষতিকর
হতে পারে।
৩. অ্যালার্জির সমস্যা
কিছু মানুষের জন্য ঢেঁড়স অ্যালার্জির কারণ হতে পারে। ঢেঁড়স খাওয়ার পর যদি কারো
শরীরে র্যাশ, চুলকানি, শ্বাসকষ্ট বা চোখে জ্বালাপোড়া হয়, তবে ঢেঁড়স খাওয়া বন্ধ
করা উচিত এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
৪. রক্তে শর্করার মাত্রা অতিরিক্ত কমানো
যদিও ঢেঁড়স ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক, তবে অতিরিক্ত ঢেঁড়স খেলে রক্তে শর্করার
মাত্রা খুব বেশি কমে যেতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীদের ঢেঁড়স খাওয়ার আগে পরিমিত
মাত্রায় সেবনের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
৫. পাকস্থলীর সমস্যা
অতিরিক্ত ঢেঁড়স খাওয়ার ফলে কিছু মানুষের পাকস্থলীর অম্লতা বৃদ্ধি পেতে পারে, যার
ফলে অ্যাসিডিটি বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হতে পারে।
৬. শ্বাসকষ্টের সমস্যা
কিছু ক্ষেত্রে ঢেঁড়সে থাকা উপাদান শ্বাসকষ্টের সমস্যা বাড়াতে পারে। বিশেষ করে
যারা হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য অতিরিক্ত ঢেঁড়স খাওয়া
ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
ঢেঁড়স সংক্রান্ত কিছু সাধারণ পরামর্শঢেঁড়সের উপকারিতা উপভোগ করতে হলে সঠিক
পরিমাণে সেবন করা উচিত। অতিরিক্ত খাওয়া নানা শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
ঢেঁড়স রান্না করার সময় অল্প তেলে ভাজা বা সেদ্ধ করে খাওয়া ভালো। বেশি তেলে ভাজা
ঢেঁড়স এর পুষ্টিগুণ নষ্ট হতে পারে।
ঢেঁড়সের সঙ্গে অন্যান্য পুষ্টিকর সবজি মিশিয়ে রান্না করা গেলে পুষ্টির মান বাড়ানো
যায়।
লেখক এর শেষ কথা
ঢেঁড়স একটি পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী সবজি। এটি হজমে সহায়তা করে,
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। তবে অতিরিক্ত ঢেঁড়স খেলে
কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন ডায়ারিয়া, কিডনির পাথর, এবং
শ্বাসকষ্টের সমস্যা। সঠিক পরিমাণে খেলে ঢেঁড়সের উপকারিতা পাওয়া সম্ভব।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url